আলাদা খাট
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
সবে মাত্র রাতের অন্ধকার ঠেলে দূর থেকে দিবাকর উঁকি মারছে পুবের আকাশে। দূর থেকে কানে ভেসে এলো আজানের ধ্বনি। মামাবাড়ির বিছানায় ঘুমটা বেশ পাতলা হচ্ছিল সারারাত। তাই আজানের ধ্বনি কানে আসতেই ভাবলাম আজ ভোরের সূর্য দেখবো দুই বোনে। কতকাল সূর্য ওঠা দেখিনি।
আগে কিশোরী বেলায় আমি আর নিপা দিদি কালী পূজার এক সপ্তাহ আগে থাকতেই মামাবাড়িতে চলে আসতাম। দিনের আলো ফোটার আগেই মামাদের কালী তলায় গিয়ে গোবর দিয়ে মাড়ুলি দিয়ে আসতাম। তারপর ফ্রকের কোঁচড় ভরে শিউলি ফুল কুড়িয়ে মাড়ুলিটা সাজাতাম খুব সুন্দর করে। কি অনাবিল আনন্দ ছিল তখন!
তাই ভাবলাম আজ ভোরে নিপা দিদিকে তুলে নিয়ে যাবো মামাদের কালী তলায়। কিন্তু পাশ ফিরে দেখি দিদি নেই। মনে মনে ভাবলাম, দিদি কি তাহলে আমার আগেই উঠে চলে গিয়েছে কালী তলায়।
কালকে রাতে শুয়ে শুয়ে দিদি বলছিল, কতদিন শিউলি ফুল কুড়িয়ে ঠাকুরকে দিইনি। আর শিউলি ফুল দিয়ে হাতে কেমন মেহেন্দি করতাম। মনে আছে বোন তোর?
আমিও আর বিছানায় পড়ে না থেকে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে মেঝেতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মশারির খুঁটগুলো খুলতে লাগলাম। এমন সময় দেখি নিপাদি ঘরে ঢুকছে। গায়ে রয়েছে রাতের আকাশী রঙের সুতির নাইটিটা। হাউস কোট বা ওড়না কিছুই নেই।
আমি বললাম, কি রে দিভাই কোথায় গিয়েছিলি এতো ভোরে? আমি তো ভাবলাম তুই কালী তলায় গিয়েছিস। নিপাদি আমার থেকে তিনেকের বড় হলেও তুই তুকারি করেই ডাকি ছোট থেকে।
নিপাদি বলল, থাক তোকে আর মশারি খুলতে হবে না। এখনও বেশ মশা আছে।বলেই ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
আমিও পুনরায় মশারির খুঁটগুলো লাগিয়ে দিলাম যথারীতি। তারপর কাঠের চেয়ারটা ঘরের কোণ থেকে টেনে এনে বিছানার পাশটিতে বসে আবার জিজ্ঞাসা করলাম কি রে কোথায় গিয়েছিলি বললি না তো?
– কোথায় আবার যাবো! গিয়ে ছিলাম রিমি আর তিসির ঘরে সেই মাঝরাতে।
– কেন রে?
– আসলে কি জানিস তো। আমার তিসিকে ছাড়া একদম ঘুম আসতে চায় না।
-ওওওও তাই বল। হ্যাঁ রে দিভাই তুই যে তিসিকে নিয়ে আলাদা ঘুমাস তাতে জামাইবাবু আপত্তি করে না? মানে আমি বলতে চাইছি তোর আর জামাইবাবুর বয়স তো এখন চল্লিশের কোঠায়। এই বয়স থেকেই স্বামী স্ত্রী আলাদা আলাদা জায়গায় তোরা রাতে ঘুমাচ্ছিস?
নিপাদি হাত নেড়ে বলল, না না তোর কি মাথা খারাপ? এই বয়স থেকে আমি স্বামীসঙ্গ ত্যাগ করবো! আমার বিয়ের ডবল বেডে আমরা তিনজনই শুয়ে পড়ি।
– আমি প্রশ্ন করলাম, মানে তুই, জামাইবাবু আর তিসি এক বিছানায় ঘুমাস রাতে। তাই তো?
– হ্যাঁ তাই তো। কেন তুই তোর মেয়েকে রাতে তোদের কাছে নিয়ে ঘুমাস না?
– না রে দিভাই। রিমি পাঁচ বছর বয়স থেকেই আলাদা ঘরে শোয়।
রীতিমতো আঁতকে উঠে নিপাদি বলল, সে কি কথা। এইটুকু ছোট মেয়ে রাতে একা একা ঘুমায় কি করে।
কিছুটা ধমকের সুরে বলল, হ্যাঁ রে নিশা তোর কি কান্ডজ্ঞান নেই। রাত্রি বেলায় মেয়েটা যদি ভয় টয় পেয়ে বসে।
-ভয় পেলে আমি ছুটে যাই তো পাশের রুম থেকে। সেদিন হয়তো ওর কাছেই সারারাত শুয়ে রইলাম।
– ঠোঁট বেঁকিয়ে নিপাদি বলল, বাপু এতো নাটকের কি আছে। দশ বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তোরা স্বামী স্ত্রীতে বড় খাটে আরাম করে ঘুমাতেই পারিস।
– সে হয়তো পারি। কিন্তু আমার মন সায় দেয় না। মা বাবার ঘনিষ্ঠতা ওর কিশোরী মনে প্রভাব ফেলুক এটা আমরা চাই না।
– ওরে ছোট মেয়ে ওরা, ঘুমিয়ে পড়লে ওদের কোনো জ্ঞান থাকে না। বেশ বিরক্ত হয়ে বলল নিপাদি।
– দেখ দিভাই তুই যাই বলিস না কেন আমি তোর যুক্তি মানতে পারলাম না। কিশোর বয়স থেকেই ধীরে ধীরে যৌবনের দিকে যায় মানব শরীর। এই সময় ওদের মনে নানা রকমের কৌতুহল জেগে ওঠে। আর বিদেশে তো আঠেরো মাস বয়স থেকেই বাচ্চার জন্য আলাদা বিছানার ব্যবস্থা করা হয়। একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সব বাচ্চা ছোট থেকে আলাদা ঘুমায় তাদের রাতে ঘুমের পরিমাণও যথেষ্ট ভালো হয়। ফলে তারা সারাদিন অনেক বেশি চনমনে থাকে।
আমার শেষ কথাগুলো নিপা দি খুব মন দিয়ে শুনছিল লক্ষ্য করলাম। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, এটা কিন্তু তুই ঠিক বলেছিস। বিছানায় কেউ বারবার পাশ ফিরলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। সেখানে বিছানার মধ্যে …না রে নিশা আমি এবার বাড়ি গিয়েই তিসির জন্য আলাদা ঘরে একটা খাটের ব্যবস্থা করব। ওকে রাতে একা শোয়াবো। দেরী যা হওয়ার হয়ে গেছে আর নয়। আমি না হয় মাঝে মধ্যেই তিসির রুমে গিয়ে শোবো। সুঅভ্যাস এর বিকল্প নেই।
আমি মনে মনে বললাম, যাক বাবা। শেষ পর্যন্ত বড় দিদি হয়ে যে ছোট বোনের কথা শুনল এটাই আমার সৌভাগ্য। আগে যৌথ পরিবারের বিধবা ঠাকুমারা নাতি নাতনীদের নিয়ে শুতো। কিন্তু এখনকার পরমাণু পরিবারগুলোতে সেই সুবিধা নেই। তাই বলে কি থেমে যাবে এতদিনের সায়েন্টিফিক পন্থা।না কখনো না। আমরা অভিভাবকরাই পারি আমাদের সন্তানদের জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে নিজের বাড়ি থেকেই। শুধু আবেগ নয় সন্তানকে বড় করতে হবে বিবেক বুদ্ধি দিয়ে।